বাংলাদেশের ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া তার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকাল (১৯৯১-১৯৯৬) একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়ে তিনি দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে বড় ধরনের সংস্কার আনেন এবং অর্থনীতিকে একটি নতুন গতিপথে চালিত করেন। এই নিবন্ধে তার নেওয়া অর্থনৈতিক সংস্কার এবং এর ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও নীতিমালার পরিবর্তন
১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেগম খালেদা জিয়া তার সরকারকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত করেন। তার সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল বাজারমুখী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা, বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ। তিনি দেশের অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য নীতিমালা পরিবর্তন করেন।
বাজারমুখী অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়া
বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণ শুরু করেন। এই পদক্ষেপটি দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে উন্নত করার জন্য একটি বড় উদ্যোগ ছিল। বেসরকারীকরণের মাধ্যমে তিনি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন, যা দেশের উৎপাদনশীলতাকে উন্নত করে। তার সরকারের সময়ে রপ্তানি খাত বিশেষ গুরুত্ব পায়। পোশাক খাতের বিকাশ তার সময়ে রপ্তানি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসারের ফলে লক্ষাধিক নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগ
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করে। করছাড়, সহজ ভিসা প্রক্রিয়া, এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা তার সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি। এ সময়ে টেলিকম এবং বিদ্যুৎ খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তার সরকারের এই উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করে।
শিল্পায়নে বিশেষ গুরুত্ব
শিল্প খাতের বিকাশে বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেন। তিনি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করেন। এর মধ্যে রয়েছে সহজ ঋণ সুবিধা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা। তার সরকারের সময়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পরিণত হয়।
নারী শ্রমিকদের ভূমিকা
গার্মেন্টস শিল্পের প্রসারের ফলে দেশের নারীরা ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পান। এটি শুধু নারী ক্ষমতায়নেই নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পরিবার এবং সমাজে তাদের অবস্থানকে সুসংহত করে।
কৃষি খাতের উন্নয়ন
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার সরকারের সময়ে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সার বিতরণ সহজলভ্য করা, এবং কৃষকদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। এসব পদক্ষেপ খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটায় এবং দেশের খাদ্য ঘাটতি হ্রাস করতে সহায়ক হয়।
সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন
তার সরকার দেশের সেচ ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়। সেচের পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানো হয়। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
অবকাঠামো উন্নয়ন
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি শক্তিশালী অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া তার মেয়াদে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প শুরু করেন। তার সরকারের সময়ে সড়ক, রেলপথ, এবং বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটে।
সড়ক ও রেলপথের উন্নয়ন
দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ করতে সড়ক ও রেলপথের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। নতুন সড়ক নির্মাণ এবং পুরনো রেলপথ সংস্কারের মাধ্যমে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা হয়।
বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা হয়। তার সরকারের সময়ে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, যা দেশের শিল্প এবং গৃহস্থালির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার
খালেদা জিয়া তার সরকারের সময়ে ব্যবসায়িক পরিবেশকে সহজ এবং প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। দেশের ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানি শুল্ক হ্রাস এবং বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানো হয়।
ইতিবাচক প্রভাব ও দীর্ঘমেয়াদি অবদান
বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে নেওয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো শুধু স্বল্পমেয়াদি উন্নয়নেই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তার উদ্যোগে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুসংহত হয়, যা ভবিষ্যতে আরও বড় উন্নয়নের জন্য মজবুত ভিত্তি তৈরি করে।
- রপ্তানি খাতের বিকাশ: তার সরকারের নীতিমালা দেশের রপ্তানি আয় বহুগুণ বাড়িয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পের প্রসার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে একটি প্রধান সরবরাহকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
- নারী ক্ষমতায়ন: কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা ও সামাজিক অবস্থানকে উন্নত করেছে। নারীদের অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করেছে।
- কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি: খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী করেছে।
- বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন: শিল্প এবং গৃহস্থালির বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
- ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি: ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা অর্থনীতিতে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রবেশ নিশ্চিত করেছে।
উপসংহার
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের শাসনামলে বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বিপ্লব ঘটেছিল, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেশের অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল ভিত্তি প্রদান করেছে এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তার সময়ে নেওয়া সংস্কারগুলোর ইতিবাচক প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।