ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বেগম খালেদা জিয়া। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, বরং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে এক অনন্য নেতৃত্ব। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন, সংগ্রাম, অর্জন, ও উত্তরাধিকার আজও প্রাসঙ্গিক। এই প্রবন্ধে আমরা তার জীবনের ধারাবাহিক বিবরণ তুলে ধরব, যেখানে তার জন্ম, রাজনৈতিক যাত্রা, নেতৃত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং দেশের প্রতি তার অবদান বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ইস্কান্দার মজুমদার এবং মাতা ছিল তায়েবা মজুমদার। তার শৈশব ও শিক্ষাজীবন কেটেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে।
খালেদা জিয়া দিনাজপুরের এক সরকারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে দিনাজপুর গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি দিনাজপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। তবে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণবশত তার উচ্চশিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
পারিবারিক জীবন ও রাজনৈতিক জগতে প্রবেশ
১৯৬০ সালে খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। যুদ্ধের সময় খালেদা জিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। যুদ্ধশেষে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত হন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন।
কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। এই ঘটনাটি খালেদা জিয়ার জীবনে একটি বড় মোড় এনে দেয়। স্বামীর হত্যার পর তিনি সরাসরি রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
বিএনপি’র নেতৃত্ব গ্রহণ
১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এটি ছিল তার জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, কারণ তখন দলটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সামরিক শাসন চলছিল, এবং রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল প্রতিকূল।
তার নেতৃত্বে বিএনপি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে। তিনি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেন।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া (১৯৯১-১৯৯৬)
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন। তার নেতৃত্বে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সময়ে তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জন ছিল:
- সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন
- বিনামূল্যে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করা
- বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা
দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া (১৯৯৬-২০০৬)
তিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়া (২০০১-২০০৬)
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি আবারো ক্ষমতায় আসে, এবং খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন।
এই সময়ে তার সরকারের কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল:
- বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো উন্নয়ন
- দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা
- গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন
তবে ২০০৬ সালের শেষে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যা ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে।
গ্রেফতার ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ (২০০৭-২০১৮)
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালীন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি প্রায় এক বছর কারাগারে ছিলেন। পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়, এবং তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হন।
২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় তাকে গুলশান কার্যালয়ে অন্তরীণ রাখা হয়। ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে কারাগারে রাখা হয়।
শারীরিক অসুস্থতা ও বর্তমান অবস্থা
২০১৮ সালে কারাগারে থাকাকালীন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে, তিনি এখনো চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে পারছেন না।
বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তার অবদান আজও আলোচিত।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি শুধু একজন নেতা নন, বরং সংগ্রামের প্রতীক। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে তার অবদান, আত্মত্যাগ এবং নেতৃত্ব আজও অনুপ্রেরণার উৎস।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার নাম চিরস্মরণীয় থাকবে।