জিয়াউর রহমান: বাংলাদেশের এক সাহসী সৈনিক ও রাষ্ট্রনায়ক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রগঠন, ও সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে জিয়াউর রহমান ছিলেন এক অবিস্মরণীয় নাম। একজন মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবন, কর্ম, রাজনৈতিক দর্শন, এবং দেশের প্রতি তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা করাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

প্রথম জীবন ও সামরিক জীবন

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মনসুর রহমান ছিলেন এক সরকারি কর্মকর্তা, যার ফলে শৈশব থেকেই শৃঙ্খলা ও শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। ছোটবেলায় তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। তাঁর কর্মজীবনে তিনি কাশ্মীর যুদ্ধসহ বিভিন্ন সামরিক অভিযানে অংশ নেন এবং দক্ষতা ও বীরত্বের জন্য প্রশংসিত হন।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা

১​১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১:৩০টায়, মেজর জিয়াউর রহমান বন্দরে জেনারেল আনসারির কাছে রিপোর্ট করতে যাওয়ার পথে  আগ্রাবাদে মেজর খালেকুজ্জামান ক্যাপ্টেন ওলি আহমদের পাঠানো বার্তা নিয়ে উপস্থিত হন, যেখানে জানানো হয় যে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে এবং বহু মানুষকে হত্যা করছে। এই সংবাদ পাওয়ার পর, মেজর জিয়াউর রহমান কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেন, "আমরা বিদ্রোহ করছি," এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২৬ মার্চ রাত ২:১৫ মিনিটে তিনি তার ব্যাটালিয়নের অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) এবং সৈনিকদের সমবেত করে তাদের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন এবং সামরিক পরিকল্পনা তুলে ধরেন।​ এরপর, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন, তবে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা জনগণকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।

প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা (২৬ মার্চ, ১৯৭১)

জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ:

দ্বিতীয় স্বাধীনতার ঘোষণা (২৭ মার্চ, ১৯৭১)

তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় জেড ফোর্স (Z Force) গঠন করেন এবং নেতৃত্ব দেন। তাঁর অধীনে থাকা বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযান পরিচালনা করে এবং মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক অভ্যুত্থান

স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর দেশ এক চরম রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে। একের পর এক অভ্যুত্থানের মধ্যে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে "সিপাহী-জনতার বিপ্লব" নামে পরিচিত ঘটনা ঘটে, যেখানে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী সময়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ নেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবদান

জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এই সময়ে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা দেশের অর্থনীতি, প্রশাসন, ও পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

১. বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা

স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিল, যা অনেকের কাছে অগণতান্ত্রিক মনে হয়েছিল। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেন।

২. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন

তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। তাঁর আদর্শ ছিল "বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ", যা ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়কে গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

৩. অর্থনৈতিক সংস্কার

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। তিনি গ্রামোন্নয়ন, কৃষি ও শিল্প উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাঁর সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে "উৎপাদন বাড়াও, সংস্থান গড়ে তোল" স্লোগান চালু করা হয়।

৪. পররাষ্ট্রনীতি ও বৈশ্বিক সম্পর্ক

তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন এবং বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন। ইসলামিক দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ ছিল তাঁর অন্যতম কূটনৈতিক সাফল্য।

হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যু

১৯৮১ সালের ৩০ মে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রামে তাঁকে হত্যা করা হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক চরম শোকাবহ ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর আদর্শ ও রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

উপসংহার

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যিনি দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্ব, নীতি ও আদর্শ আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনি একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *