খালেদা জিয়া নেতৃত্ব: শোক থেকে নেতৃত্বে উত্থান (১৯৮১-১৯৯০)

গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে উত্থান

১৯৮১ সালের ৩০ মে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। সেই সময়ে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন গৃহবধূ, যিনি তার দুই সন্তান নিয়ে সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন। রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য এক গভীর শোকের ঘটনা হয়ে ওঠে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যু বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করে তোলে। এই সংকটময় সময়ে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বিএনপির নেতারা বুঝতে পারেন যে দলকে টিকিয়ে রাখতে একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন।

বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন, কিন্তু তার বার্ধক্য এবং দুর্বল নেতৃত্বের কারণে দল আরও সংকটে পড়ে। এর মধ্যেই সামরিক ও রাজনৈতিক চক্রে শুরু হয় নানা জল্পনা। এরশাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক শাসন বিএনপিকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। ঠিক এই সময়ে দলের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, বেগম খালেদা জিয়াকেই দলের নেতৃত্বে আনা হবে। যদিও রাজনীতির প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না, কিন্তু দল এবং দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ তাকে এই ভূমিকায় আসতে বাধ্য করে।

একটি জাতির শোক এবং নেতৃত্বে উত্থান

বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নেন শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য নয়, বরং একটি ভেঙে পড়া দলকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিতে। তার শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। সেই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে তিনি সাধারণ জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন এবং তাদের সমর্থন আদায় করেন। তার নিরলস পরিশ্রমের ফলে বিএনপি ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হয়।

১৯৮২: রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক প্রবেশ

১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন। এটি তার রাজনৈতিক জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা। একই বছরের নভেম্বরে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করার সময় তিনি প্রথমবারের মতো জনগণের সামনে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্য নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগায়। এ সময়ে তিনি দলের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেন।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ছিল সাহসী এবং দৃঢ়। ১৯৮৩ সালে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন। তার শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে বিএনপি একটি সক্রিয় বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৪ সালের মে মাসে তিনি দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলন ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ঘটায়। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি মাইলফলক ছিল।

তার আন্দোলনের সফলতা সাধারণ জনগণের কাছে তাকে একজন আশার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তার ত্যাগ এবং সংগ্রাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করে।

BNP প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার ভূমিকা

জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর বেগম খালেদা জিয়া দলের সাংগঠনিক কাঠামো আরও শক্তিশালী করেন। তিনি দলের তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করেন। তার নেতৃত্বে বিএনপি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে।

বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়া এবং নেতৃত্বের দৃঢ়তা

বিএনপির ভেতরেও তখন নানা মতবিরোধ ছিল। দলের কিছু অংশের নেতারা তাকে নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু তার নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং জনগণের প্রতি তার অঙ্গীকারের ফলে তিনি এই বিরোধিতাকে অতিক্রম করেন। তার নেতৃত্বের অধীনে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে আরও সুসংগঠিত হয়।

উপসংহার

১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সালের সময়কালে বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছেন, তা তাকে জাতীয় ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তার শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার গল্প, রাজনৈতিক সংগ্রামে তার ত্যাগ এবং নেতৃত্বের দৃঢ়তা তাকে আপোষহীন নেত্রীর তকমা এনে দিয়েছে। তার জীবন এবং সংগ্রাম শুধু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য একটি অনুপ্রেরণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *